কারেন্ট বিল বের করার সহজ নিয়ম

কারেন্ট বিল বের করার সহজ নিয়ম

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বিদ্যুৎ বা কারেন্ট। সাধারণত বাসাবাড়ির বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য প্রযোজ্য। ফ্যান, লাইট, টিভি, ফ্রিজ, এসি ইত্যাদি ব্যবহার করে যত ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়, তা অনুযায়ী বিল আসে। আবাসিক গ্রাহকদের জন্য ইউনিট প্রতি রেট তুলনামূলকভাবে কম এবং স্ল্যাব অনুযায়ী চার্জ ধার্য করা হয়।এটি ছাড়া আধুনিক জীবন প্রায় অকল্পনীয়। ঘর আলো করা থেকে শুরু করে ফ্রিজ, ফ্যান, এসি, মোবাইল চার্জ—সবই নির্ভর করে বিদ্যুতের উপর। আর এই বিদ্যুতের ব্যবহার অনুযায়ী প্রতি মাসে আমাদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিল পরিশোধ করতে হয়। তবে অনেকেই সঠিকভাবে জানেন না কিভাবে এই বিল হিসাব করা হয়। এই লেখায় আমরা সহজভাবে শিখব কীভাবে নিজের বাসা বা দোকানের কারেন্ট বিল নিজেই বের করতে পারেন।   



  • কারেন্ট বিলের ধরন
  • ইউনিট কিভাবে গণনা হয়
  • ইউনিট অনুযায়ী চার্জ রেট
  • ভ্যাট ও অন্যান্য চার্জ
  • মিটার রিডিং পড়ার নিয়ম
  • নিজে নিজে বিল ক্যালকুলেট করার পদ্ধতি
  • একটি উদাহরণসহ প্র্যাকটিকাল ক্যালকুলেশন
  • কিছু সচেতনতার পরামর্শ

কারেন্ট বিলের ধরন

বাংলাদেশে মূলত দুই ধরনের বিদ্যুৎ বিল হয়ে থাকে। ঘর বা বাড়ির ব্যবহারের জন্য আর অন্যটি দোকান, অফিস বা ছোট শিল্পকারখানার জন্য এক ধরনের ব্যবস্থা কে বলা হয় আবাসিক এবং অন্যটি বানিজ্যিক।এছাড়াও আছে শিল্প (Industrial), কৃষি (Agricultural), শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদি বিশেষ শ্রেণির সংযোগ। তবে সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আবাসিক ও বাণিজ্যিক।বিদ্যুৎ বা কারেন্ট আমাদের আধুনিক জীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ঘর থেকে শুরু করে অফিস, শিল্প-কারখানা, হাসপাতাল—প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের ব্যবহার অপরিসীম। এই বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য গ্রাহকদের একটি নির্দিষ্ট অংকের বিল দিতে হয়, যাকে আমরা সাধারণভাবে কারেন্ট বিল  বলে থাকি। কিন্তু এই বিল সবার জন্য একই রকম নয়।দোকান, অফিস, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, ব্যাংক ইত্যাদির জন্য প্রযোজ্য। এখানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ খরচের হার আবাসিক বিলের চেয়ে বেশি, কারণ এখানে ব্যবহার বেশি এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। ব্যবহার, শ্রেণি ও বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী এই বিলের ধরনে ভিন্নতা দেখা যায়।কারখানা, মিল, উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির জন্য শিল্প শ্রেণিভুক্ত বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে। এদের জন্য বিল একটু জটিল ও আলাদা নিয়মে নির্ধারিত হয়। অনেক সময় দিনে ও রাতে আলাদা রেট থাকে। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে “Bulk” হিসেবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।চাষাবাদের জন্য পানি তোলার পাম্প ইত্যাদিতে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ আলাদা হারে চার্জ করা হয়। অনেক দেশে কৃষি বিদ্যুৎ সংযোগে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়া হয় যাতে কৃষকেরা কম খরচে চাষ করতে পারে।


ইউনিট কিভাবে গণনা হয়?

বিদ্যুৎ ব্যবহার পরিমাপ করা হয় কিলোওয়াট আওয়ার বা ইউনিট হিসেবে। ১ ইউনিট = ১ কিলোওয়াট-আওয়ার।আপনি যদি ১ কিলোওয়াট ক্ষমতার (যেমন ১০০০ ওয়াট) একটি যন্ত্র ১ ঘণ্টা চালান, তাহলে তা ১ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ করবে।অন্যদিকে  ৫টি ১০০ ওয়াটের বাল্ব ২ ঘণ্টা চলে, তাহলে খরচ হবে = ৫ × ১০০ × ২ = ১০০০ ওয়াট-আওয়ার = ১ ইউনিট।

 ইউনিট অনুযায়ী চার্জ রেট (আবাসিক)

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (PDB), ডেসকো (DESCO), ডিপিডিসি (DPDC) ও অন্যান্য কোম্পানির রেট কিছুটা ভিন্ন হলেও সাধারণত নিম্নরূপ হয় (আবাসিক গ্রাহকের জন্য)।


ইউনিট (kWh) প্রতি ইউনিটের দাম
০-৫০ ৩.৫০ টাকা
৫১-৭৫ ৪.০০ টাকা
৭৬-২০০ ৫.৫০ টাকা
২০১-৩০০ ৬.০০ টাকা
৩০১-৪০০ ৬.৫০ টাকা
৪০১-এর বেশি ৭.০০ টাকা
চলমান... চলমান..                       


 হিসাব করুন

ধরুন, আপনার এই মাসে ব্যবহৃত ইউনিট ২৫০। তাহলে বিল হবে প্রথম ৫০ ইউনিট = ৫০ × ৩.৫০ = ১৭৫ টাকা,পরের ২৫ ইউনিট = ২৫ × ৪.০০ = ১০০ টাকা,পরের ১২৫ ইউনিট = ১২৫ × ৫.৫০ = ৬৮৭.৫০ টাকা,বাকি ৫০ ইউনিট = ৫০ × ৬.০০ = ৩০০ টাকা, মোটঃ ১৭৫ + ১০০ + ৬৮৭.৫০ + ৩০০ = ১২৬২.৫০ টাকা।   অনেক সময়ই বিদ্যুৎ কোম্পানি একটি নির্দিষ্ট "ফিক্সড চার্জ" নেয়। ধরুন ১০০ টাকা ফিক্সড চার্জ এবং ৫% ভ্যাট।স্থায়ী চার্জ = ১০০ টাকা,ভ্যাট = (১২৬২.৫০ + ১০০) × ৫% = ৬৮.১২ টাকা।

কোন কোন যন্ত্র কত ইউনিট খরচ করে

ঘরের যন্ত্রপাতির ব্যবহার জেনে আপনি আন্দাজ করতে পারবেন মাসে কত ইউনিট ব্যবহার হতে পারে

যন্ত্রপাতি বিদ্যুৎ খরচ (ওয়াট) দৈনিক ঘণ্টা দৈনিক ইউনিট মাসিক ইউনিট
বাল্ব (LED) ১০ ওয়াট ৫ ঘণ্টা ০.০৫ ইউনিট ১.৫ ইউনিট
ফ্যান ৭৫ ওয়াট ১০ ঘণ্টা ০.৭৫ ইউনিট ২২.৫ ইউনিট
টিভি ১০০ ওয়াট ৬ ঘণ্টা ০.৬ ইউনিট ১৮ ইউনিট          
ফ্রিজ ৩০০ ওয়াট ২৪ ঘণ্টা ২.৪ ইউনিট ৭২ ইউনিট
গিজার ২০০০ ওয়াট ১ ঘণ্টা ২ ইউনিট ৬০ ইউনিট     

এভাবে আপনি চাইলে প্রতিটি যন্ত্রের জন্য আলাদা করে ইউনিট বের করে মোট ইউনিট হিসাব করতে পারেন।

বর্তমানে বিদ্যুৎ বিল চেক করাও সহজ হয়ে গেছে। বিভিন্ন কোম্পানির নিজস্ব অ্যাপ বা ওয়েবসাইট আছে যেখানে আপনি মিটার নম্বর দিয়ে বিল দেখে নিতে পারেন।উদাহরণ:BPDB Smart Prepaid App. DPDC Bill Checker.REB Bill App.Palli Bidyut Smart Meter App.

এসব অ্যাপে আপনি চাইলে ব্যবহার, রিচার্জ, বিল হিসাব সবই এক জায়গায় দেখতে পারেন।

 প্রিপেইড ও পোস্টপেইড মিটারে পার্থক্য

প্রিপেইড:
আপনি রিচার্জ করলে তবেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন।ইউনিট শেষে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়।নিজের খরচ সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

পোস্টপেইড:
আগে ব্যবহার, পরে বিল আসে।একবারে বেশি খরচ হয়ে যেতে পারে।সময়মত বিল না দিলে জরিমানা হয়। কিছু সাধারণ ভুল ধারণা, ফ্যান বা এলইডি বাল্ব তেমন ইউনিট খরচ করে না ,এটা ঠিক, তবে অনেকক্ষণ চালালে খরচ বাড়ে।শুধু বড় যন্ত্রই বেশি খরচ করে ,ছোট যন্ত্রও যদি দিনের পর দিন চলে, তখন তা মিলিয়ে অনেক ইউনিট হয়। ডাবল রেট/নাইট রেট সব জায়গায় প্রযোজ্য এটি নির্ভর করে আপনি কোন এলাকায় আছেন এবং কোন কোম্পানির সংযোগ ব্যবহার করছেন।

কীভাবে বিদ্যুৎ খরচ কমানো যায়

এলইডি লাইট ব্যবহার করুন,ফ্রিজের দরজা বারবার খুলবেন না,ইনভার্টার বা এনার্জি-সেভিং ফ্যান ব্যবহার করুন,প্রয়োজন ছাড়া চার্জার বা টিভি চালু রাখবেন না,দিনের আলো ব্যবহার করুন, রাতের আগে লাইট জ্বালাবেন না। পুরনো ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি বদলে এনার্জি এফিশিয়েন্ট মডেল কিনুন।
রুমে ঢোকার সাথে সাথেই ফ্যান বা বাতি চালু করবেন না, আগে ভাবুন প্রয়োজন আছে কি না।এসি ২৪-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখলে বিদ্যুৎ খরচ কম হয়।ঘরের জানালা খুলে প্রাকৃতিক বাতাস প্রবেশ করতে দিন – এতে ফ্যান বা এসি কম ব্যবহার হয়।ফ্রিজ বারবার খোলা বন্ধ না করাই ভালো।টিভি, চার্জার বা কম্পিউটার স্ট্যান্ডবাই মোডে না রেখে পুরোপুরি বন্ধ করুন।পানির হিটার প্রয়োজন ছাড়া চালু রাখবেন না।ঘরের দেয়াল হালকা রঙের রাখলে আলো কম জ্বলিয়ে কাজ চলে।বাচ্চাদের পড়ার জায়গা জানালার পাশে রাখলে দিনেও আলো জ্বালাতে হয় না।পরিমিত ভাজাভুজি করলে হুড বা এক্সহস্ট ফ্যান কম চালাতে হয়।মাইক্রোওয়েভ বা ইলেকট্রিক ওভেন চালানোর সময় ঘড়ি দেখে সময় নির্ধারণ করুন।বিদ্যুৎচালিত পানি পাম্প বেশি সময় চালাবেন না, পর্যাপ্ত পানি হলে বন্ধ করুন।ইলেকট্রিক কেটলি বা রাইস কুকার চালিয়ে ভুলে যাবেন না নজর দিন।লন্ড্রি একসাথে করে ওয়াশিং মেশিন কম বার চালান।সোলার লাইট বা সোলার ফ্যান ব্যবহার করলে খরচ অনেকটাই কমে।মাস শেষে মিটার রিডিং নিজে দেখে হিসাব রাখুন – খরচ কমানোর সচেতনতা বাড়বে।  

ভ্যাট ও অন্যান্য চার্জ

আমরা সবাই মাস শেষে বিদ্যুৎ বিল দিই, কিন্তু অনেকেই জানি না সেই বিলে ঠিক কী কী চার্জ ধরা হয়। শুধুমাত্র ইউনিট খরচ নয়, এর সঙ্গে যুক্ত থাকে আরও কিছু বাড়তি খরচ, যার মধ্যে অন্যতম হলো ভ্যাট (VAT), সার্ভিস চার্জ ও ডিমান্ড চার্জ।

প্রথমত, ভ্যাট  এটি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে ৫% হারে নেওয়া হয়। অর্থাৎ যত ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তার মোট মূল্যের উপর ৫% ভ্যাট যুক্ত হবে।

দ্বিতীয়ত,ডিমান্ড চার্য এটি মূলত বাণিজ্যিক ও শিল্প খাতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এই চার্জ নির্ধারিত হয় সংযোগের ক্ষমতা (কেভিএ) অনুযায়ী।

তৃতীয়ত, সার্ভিস চার্জ  – এটি একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক যা বিদ্যুৎ সংযোগের রক্ষণাবেক্ষণ ও সেবা নিশ্চিত করার জন্য নেওয়া হয়রএছাড়াও কখনও কখনও বিলের মধ্যে জরিমানা   যুক্ত হতে পারে, যদি সময়মতো বিল পরিশোধ না করা হয়।এইসব চার্জ একত্রিত হয়ে বিদ্যুৎ বিলের মোট অঙ্ক তৈরি করে। তাই কারেন্টের খরচ বুঝতে হলে কেবল ইউনিট নয়, এসব অতিরিক্ত চার্জও নজরে রাখতে হবে।


মিটার রিডিং পড়ার নিয়ম

বিদ্যুৎ বিল নির্ধারণের জন্য মিটার রিডিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। মিটার দেখেই বোঝা যায় আপনি কত ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন। নিচে ধাপে ধাপে মিটার রিডিং পড়ার নিয়ম দেওয়া হলো: 

  • বেশিরভাগ ডিজিটাল মিটারে একটি ছোট স্ক্রিন থাকে, যেখানে সংখ্যা ঘুরতে থাকে। কেউ কেউ এনালগ মিটারও ব্যবহার করে, যেগুলোতে কয়েকটি চাকা ঘুরে ঘুরে সংখ্যা দেখায়।

  • মিটারের স্ক্রিনে যেই সংখ্যাটি দেখায় (যেমন: 015243), সেটি ইউনিট হিসেবে ধরা হয়। এটিই বর্তমান রিডিং।

  • আপনার পূর্বের বিদ্যুৎ বিল বা মিটারের আগের নোট করা সংখ্যা দেখুন। ধরুন, আগের রিডিং ছিল 014950।                         


নিজে নিজে বিল ক্যালকুলেট করার পদ্ধতি

মিটারের বর্তমান রিডিং থেকে আগের রিডিং বাদ দিন ।
যেমনঃবর্তমান   রিডিং = 015800 ।আগের মাসের রিডিং = 015500।ব্যবহৃত ইউনিট = 015800 - 015500 =300 ইউনিট।বাংলাদেশে আবাসিক (গ্রাহক শ্রেণি অনুযায়ী) বিদ্যুৎ ইউনিটের দাম ধাপে ধাপে বাড়ে ।
উদাহরণস্বরূপঃ

ইউনিট (kWh) প্রতি ইউনিট দাম (৳)
০–৭৫ ৪.০০৳
৭৬–২০০ ৫.৫০৳
২০১–৩০০ ৬.৫০৳
৩০১–৫০০ ৭.০০৳
৫০০+ ৮.০০৳


কিছু সচেতনতার পরামর্শ

বর্তমান সময়ে বিদ্যুৎ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে অফিস-আদালত, শিল্পকারখানা – সবখানেই বিদ্যুতের ব্যবহার অপরিহার্য। তবে দিনে দিনে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, এবং তার সাথে বাড়ছে আমাদের মাসিক বিদ্যুৎ বিল। তাই এই খরচ কমানোর একমাত্র উপায় হলো সচেতনতা। বিদ্যুৎ ব্যবহার নিয়ে কিছু সহজ নিয়ম মেনে চললে আমরা নিজেরাও বিল কমাতে পারি, এবং একইসাথে জাতীয় সম্পদ রক্ষা করতে পারি।

প্রথমত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অপ্রয়জনে বিদুৎ অপচয় না করা।  অনেকেই একটি ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে গেলেও বাতি, ফ্যান বা এসি বন্ধ করেন না। এটি নিছক অলসতা হলেও এর প্রভাব পড়ে মাসিক বিলে। দিনের বেলায় যেখানে প্রাকৃতিক আলো রয়েছে, সেখানে বৈদ্যুতিক আলো ব্যবহার না করাই ভালো। দিনের আলো কাজে লাগানো শুধু বিল কমায় না, চোখের জন্যও আরামদায়ক।

দ্বিতীয়ত, এনার্জি এফিসিয়েন্ট যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা   অত্যন্ত কার্যকরী একটি উপায়। এলইডি বাল্ব, ইনভার্টার ফ্রিজ, স্মার্ট এসি – এগুলোর দাম হয়তো একটু বেশি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এগুলো বিদ্যুৎ খরচ অনেক কমায়। পুরনো ও বেশি বিদ্যুৎ খরচ করে এমন যন্ত্রপাতি ধীরে ধীরে বদলে ফেলা উচিত।

তৃতীয়ত, বিদ্যুৎ বিল বোঝার জন্য নিজেই রিডিং মিটার দেখা  অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। এতে বোঝা যাবে কোন মাসে বেশি ইউনিট খরচ হয়েছে, এবং কেন হয়েছে – সেটা খতিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। অনেক সময় অস্বাভাবিক বিল আসার পেছনে ভুল মিটার রিডিং দায়ী হতে পারে, যেটা আপনি আগে থেকে জানলে সংশোধনের জন্য অভিযোগ করতে পারবেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো  প্রিপেইড মিটার ব্যাবহার করা  এতে আপনি আগে থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রিচার্জ করে খরচ করতে পারবেন, যেমন মোবাইল ফোনে করে থাকেন। এতে খরচ কত হচ্ছে তা আপনি প্রতিনিয়ত দেখতে পারবেন এবং প্রয়োজন হলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।সন্তাতানদের ছোট বেলা থেকে বিদ্যুৎব্যাবহার এ সচেতন করে তোলা ।তাদের  বোঝাতে হবে যে, প্রতিটি বাতি, ফ্যান চালানো মানে একটি নির্দিষ্ট খরচ হচ্ছে, এবং সেই খরচ পরিবারের আয় থেকে যায়। শিশুদের মধ্যে এই মানসিকতা তৈরি হলে তারা ভবিষ্যতে আরো দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠবে।

সবশেষে, বিদ্যুৎ বিল কমানো মানেই কেবল টাকা বাঁচানো নয়। বরং এটি একটি জাতীয় কর্তব্য ।আমরা যদি সবাই সচেতনভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি, তবে জাতীয় পর্যায়ে বিশাল পরিমাণ জ্বালানি সংরক্ষণ সম্ভব। যার ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে।ছোট ছোট অভ্যাস ও সচেতনতা দিয়েই আমরা বিদ্যুৎ বিল অনেকটা কমিয়ে আনতে পারি। এই বিষয়ে পরিবার, প্রতিবেশী ও সমাজকে সচেতন করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। মনে রাখা উচিত বিদ্যুৎ বাঁচানো মানে দেশের সম্পদ রক্ষা করা।

বিদ্যুৎ বিল সেভিংস করার উপায়  

বর্তমান যুগে বিদ্যুৎ আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, গৃহস্থালি কাজসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের ব্যবহার অপরিসীম। তবে প্রতিদিনের ব্যবহারে বিদ্যুৎ বিলও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল শুধু পারিবারিক খরচই বাড়ায় না, বরং এটি জাতীয় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই বিদ্যুৎ বিল কমানোর বা সাশ্রয় করার কিছু কার্যকর পদ্ধতি জানা ও অনুসরণ করা আমাদের সবার জন্য জরুরি।অনেক সময় দেখা যায়, একটি রুমে কেউ না থাকলেও লাইট বা ফ্যান চালু রাখা হয়। এটি শুধু বিদ্যুতের অপচয়ই নয়, বিলও বাড়ায়। তাই রুম থেকে বের হওয়ার সময় লাইট, ফ্যান, টিভি বা অন্য যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস বন্ধ করে রাখা উচিত।পুরানো ইনসেনডেসেন্ট বা ফ্লোরোসেন্ট বাতির তুলনায় এলইডি  লাইট অনেক কম বিদ্যুৎ খরচ করে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। একটি সাধারণ এলইডি বাল্ব ৮০% পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারে। তাই ঘরের সব বাতি এলইডি দিয়ে পরিবর্তন করা বিদ্যুৎ বিল কমানোর এক চমৎকার উপায়।বর্তমানে বাজারে অনেক এনার্জি এফিশিয়েন্ট ফ্রিজ, এসি, ফ্যান, মাইক্রোওয়েভ ইত্যাদি পাওয়া যায় যেগুলোর উপর ‘স্টার রেটিং’ থাকে। যেসব পণ্যে ৫ স্টার রেটিং দেওয়া থাকে, সেগুলো তুলনামূলকভাবে কম বিদ্যুৎ খরচ করে। নতুন ইলেকট্রনিক পণ্য কেনার সময় এই বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখা উচিত।ফ্রিজের দরজা বারবার খোলা হলে এর ভেতরের তাপমাত্রা ব্যাহত হয় এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয়। তাই প্রয়োজন ছাড়া ফ্রিজের দরজা খোলা উচিত নয় এবং একবারেই যা দরকার তা বের করে নেওয়া উচিত।যাদের বাসায় এসি আছে, তারা বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয়ের জন্য কিছু বিষয় মেনে চলতে পারেন। যেমন:এসি ২৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখা।রুম ঠিকমতো সিল করা আছে কিনা দেখা।দরজা-জানালা বন্ধ রাখা।নিয়মিত এসির ফিল্টার পরিষ্কার করাএসি কম সময় চালালে এবং সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে অনেকটা বিদ্যুৎ বাঁচে।দিনের বেলা সূর্যের আলো ব্যবহার করে ঘরের লাইট বন্ধ রাখা যায়। জানালা খুলে দিয়ে প্রাকৃতিক হাওয়ায় ঠাণ্ডা রাখা যায় ঘর। এতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজন কমে আসে এবং বিদ্যুৎ বিলও কম হয়।রাতের নির্দিষ্ট সময়ে অনেক সময় লোড কম থাকে, তখন বিদ্যুতের দামও কম হয় (যদি টাইম-অব-ইউজ রেট প্রযোজ্য হয়)। সেই সময় ফ্রিজড, ইলেকট্রিক আয়রন বা ওয়াশিং মেশিন চালালে কিছুটা বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতে পারে।প্রতিমাসে বিদ্যুৎ মিটারের রিডিং দেখে নিজের বিল নিজে হিসেব করা উচিত। এতে অতিরিক্ত বিল দিলে তা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলা সম্ভব হয় এবং সময়মতো সংশোধন চাওয়া যায়।বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য শুধু ব্যক্তি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ছোট থেকেই বিদ্যুৎ ব্যবহারে দায়িত্বশীল করে গড়ে তুললে ভবিষ্যতে জাতীয়ভাবে বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব হবে।

লেখকের মন্তব্যঃআরও পড়ুন

বিদ্যুৎ হলো আধুনিক সভ্যতার প্রাণশক্তি। এর সুষ্ঠু ব্যবহার যেমন আমাদের জীবনকে সহজ করে তোলে, তেমনি অপব্যবহার আমাদের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতনতা শুধু ব্যক্তিগত সাশ্রয়ের বিষয় নয়, বরং এটি একটি বৃহৎ জাতীয় স্বার্থের সঙ্গেও জড়িত। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ক্রমাগত বাড়ছে, সেখানে প্রতিটি গ্রাহকের দায়িত্ব হলো বিদ্যুৎ ব্যবহারে সংযমী হওয়া এবং অপচয় রোধ করা।আমরা যদি গভীরভাবে বিষয়টি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাবো প্রতিদিন আমাদের অজান্তেই কতভাবে বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যেই আলো জ্বালিয়ে রাখি, দুপুর গড়িয়ে বিকেল পেরিয়ে যায় – বাতি কিন্তু তখনো জ্বলছে। ঘরে কেউ নেই, তবুও ফ্যান ঘুরছে; এসির টেম্পারেচার ২০ ডিগ্রিতে সেট করা, অথচ বাইরের তাপমাত্রা হয়তো ৩০ ডিগ্রিরও কম। মোবাইল ফোন চার্জ হয়ে যাওয়ার পরেও চার্জার প্লাগে লাগানো থাকে, টিভি বন্ধ করা হয় না। শুধু সাউন্ড কমিয়ে রাখা হয়। এসব ছোট ছোট বিষয় যেন অদৃশ্যভাবে আমাদের মাসিক বিদ্যুৎ বিলকে বাড়িয়ে তোলে।এই বাস্তবতায় আমরা যখন বলি ‘সচেতন হোন’, তখন শুধু বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হোন বলি না বলি, আপনার প্রতিটি আচরণ যেন দায়িত্বশীল হয়। একটি মাত্র বাতি নিভিয়ে আপনি হয়তো মাত্র ৫ টাকার বিদ্যুৎ সাশ্রয় করলেন, কিন্তু যদি লাখ লাখ মানুষ একই কাজ করে— তাহলে তা হয়ে যায় কোটি টাকার সাশ্রয়। একদিকে যেমন ব্যক্তির পকেট বাঁচে, তেমনি রাষ্ট্রের খরচও হ্রাস পায়। বিদ্যুৎ খাতের উপর যে চাপ পড়ে, সেটাও অনেকটা লাঘব হয়।

লেখক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও আমি বলতে পারি, আমরা অনেক সময় বুঝতেই পারি না কেন বিল এত আসে। একবার নিজের বাসায় নিয়ম করে মিটার রিডিং দেখতে শুরু করেছিলাম। প্রথম সপ্তাহে দেখলাম, দিনে প্রায় ৮ থেকে ১০ ইউনিট খরচ হচ্ছে। তখনই ভাবলাম – এটা কীভাবে কমানো যায়? অপ্রয়োজনীয় লাইট বন্ধ রাখলাম, পুরনো ফ্যান বদলে নতুন এনার্জি সেভার লাগালাম, এসির তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রিতে সেট করলাম, এবং বাচ্চাদের বললাম পড়ার সময় দিনের আলো যেন ব্যবহার করে। ফলাফল? পরের মাসেই প্রায় ৩০০-৪০০ টাকা কম বিল আসলো। এর মানে দাঁড়ায়, শুধুমাত্র সচেতনতার মাধ্যমেই বিদ্যুৎ খরচে বড় পার্থক্য আনা সম্ভব।বর্তমানে অনেকেই প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছেন, যেটা আসলে খুবই কার্যকর ব্যবস্থা। কারণ এতে বিদ্যুৎ খরচে একটা সীমাবদ্ধতা চলে আসে— আপনি যত খরচ করছেন, ততই টাকা কেটে যাচ্ছে। এতে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই একটু সংযত হয়। প্রিপেইড ব্যবস্থায় প্রতিদিন, এমনকি প্রতি ঘণ্টায় কত ইউনিট খরচ হচ্ছে সেটা দেখা যায়। ফলে নিজের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটা যেন এক ধরনের “মাইক্রো সচেতনতা”।তবে এখানেই শেষ নয়। সচেতনতা কেবল ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। এ জন্য দরকার সামাজিক ও সকল ক্ষেত্র থেকে ঊদ্যগ।কারেন্ট বিলের ধরন বৈচিত্র্যময় এবং এটি নির্ভর করে গ্রাহকের শ্রেণি, ব্যবহার, বিল পরিশোধের পদ্ধতি ও বিদ্যুৎ কোম্পানির নীতির ওপর। কেউ যদি বিলের ধরন সম্পর্কে সচেতন থাকে, তাহলে সে নিজের বিদ্যুৎ ব্যবহারও পরিকল্পিতভাবে করতে পারে এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ এড়াতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকেও ভোক্তাদের সহজ, স্বচ্ছ এবং সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহারে উৎসাহিত করা দরকার। সচেতনতা ও সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা সবাই মিলে বিদ্যুৎ ব্যবহারে ভারসাম্য আনতে পারি এবং ভবিষ্যতের জন্য টেকসই একটি সমাজ গড়তে পারি।এভাবেই আমারা সকল কিছু করতে পারি।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ইউনিভার্সাল এটুজেড এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url